জাহাঙ্গীর আলম আকাশ ।। ভাবখানা এমন যেন ওদের আসল রুপটা এবারেই দেখতে পেলেন বাঙালি। ব্লগে, ফেইসবুকে তুফান তুলেছে একদল মানুষ এই বলে যে এক জেনারেলের পত্নী পরোক্ষভাবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন জানিয়ে সেনা ছাউনির ভেতর গড়ে ওঠা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি তার কদযর্ চেহারাটা দেশবাসির সামনে পরিপূর্ণভাবে দেখিয়ে দিলো! আসলে কী তাই? নাকি পঁচাত্তরে বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে নানান কায়দা-কৌশলে পুনর্বাসন করে আসছে দলটি? এই দলটিই ঘাতক-যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধী দলটির নেতাদের মন্ত্রি, প্রধানমন্ত্রি পর্যন্ত বানিয়েছে, এটা দেশের মানুষ সবাই জানেন।
অনেকে জ্ঞানপাপীর মতো বলছে যে সাঈদীর বিচারের রায় প্রদানের কারণে ননাকি দেশের ১৬ কোটি মানুষই দারুণ খুশি! আহাম্মক এবং মুর্খের কথা এগুলি। ১৬ কোটি মানুষের মধে্য কিন্তু দেশজুড়ে যে সন্ত্রাস, তান্ডবলীলা, আগুন দেয়া, ভাংচুর, পুলিশ হত্যার সঙ্গে জড়িতরাও আছে। কাজেই এটা বলা ভুল যে সাঈদীদের বিচারের আদেশে ১৬ কোটি মানুষই খুশি? একাত্তরের ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারি, সন্ত্রাসী, জঙ্গি যারা বাংলাদেশের নাগরিক এখনও আছে তারাও ১৬ কোটির মধে্যই আছে। এসব খুনি-জঙ্গি ও ঘাতকের পাশাপাশি গোলাপী বেগম সাহেবও কিন্তু সাঈদীদের বিরুদ্ধে রায় দেয়ায় বেজায় অখুশি। এসব বাস্তব অবস্থাগুলি মাথায় রেখেই খুশি, অখুশির অংকটা কষা বোধহয় বিবেচনাপ্রসূত হবে।
যাহোক আজকের প্রসঙ্গ খুশি অখুশির নয় পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যার দোসর ও নায়কদের বিচার হবে না, যারা আমাদের মা-বোনদেরকে ‘গণিমতের মাল’ বলে পাক সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিল, যারা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, যারা বাংলার মেধাবি সন্তানদের হত্যার পর চোখ তুলে নিয়ে নৃশংসতা-বর্বরতা দেখিয়েছে তাদের বিচার করা যাবে না? এটা কী মগের মুল্লুগ নাকি বাংলাদেশে বসবাস করে ওরা এখনও পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছে?
হ্যাঁ, দেশে আইনের শাসনের অভাব আছে! তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকান্ড ও খুনিদের গ্রেফতার এবং খুনের রহস্য উন্মোচনে টালবাহানা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকে নিহত সাংবাদিকদ্বয়ের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রটনা করা আইনের শাসনহীনতারই সাক্ষ্য দেয়।
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। স্বাধীনতার ৪১ বছরেও দেশ কাঙ্খিত লক্ষে্য পৌঁছেনি। দেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি আজও। স্বাধীন দেশে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে খোদ রাষ্ট্র। দুর্নীতি এখন একধরণের ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ৪১ বছরের মধে্য ১৭ বছরই দেশবাসির কেটেছে স্বৈরশাসকদের কবলে পড়ে। সহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর সংস্কৃতি চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে সমাজপতিরা। তার মানে এই নয় যে যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস, হত্যা-নির্যাতনকে দেশের মানুষ পছন্দ করছে, কখনও না!
গণতান্ত্রিক সমাজে মত, পাল্টা মত, আলোচনা, সমালোচনা সবই চলতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত মানি না বলে গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ মারা, পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করে নিরীহ পুলিশ সদস্যদের হত্যা, দেশজুড়ে তান্ডবলীলা চালানো, বোমাবাজি, পবিত্র স্থান মসজিদ তথা উপাসনালয়ে সন্ত্রাস চালানো এসব সহিংসতা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। আর ধর্ম সেতো শান্তি, ভালবাসা ও মানবতার কথা বলে। কোন ধর্ম মানুষ হত্যা সমর্থন করে না।
সমর্থন এবং সৎ সাহস থাকলে জামায়াত-শিবির বা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনকারিরা অহিংস পথে মানুষের সমর্থন কতটুকু তার প্রমাণ দিতে পারে! লাখ লাখ লোক যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাবে অহিংসভাবে তখন পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনীর গুলিতেও কাজ হবে না। জামায়াত-শিবির সহিংসতায় বিশ্বাস না করলে হয়ত তারাও বিকল্প একটি শাহবাগ মঞ্চ তৈরী করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না কেন? আর জামাত-শিবিরের অহিংস কোন প্রতিবাদের ওপর যদি পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী গুলি চালাতো, তখন তারা বলতে পারতো যে তাদের ওপর সরকার অবিচার করছে।
গুপ্তহত্যা, চোরাগোপ্তা হামলা, হাত-পায়ের রগ কাটা, বোমাবাজি, ধমর্ীয় উন্মাদনা সৃষ্টি এসব ওদের পুরনো স্টাইল। রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্ত্রাসের কালো চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি। সেই পুরনো স্টাইলে সাঈদীর বিচারের আদেশকে উপলক্ষ করে তারা আবার মাঠে নেমেছে। চালাচ্ছে চোরাগোপ্তা হামলা, দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলা ভাইয়ের হত্যা-নির্যাতন, উদীচীর সম্মেলন, সিপিবির সমাবেশ, ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবং আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা-গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা এবং গাইবান্ধায় ১৮ জন কৃষকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেশবাসি ভোলেনি। সাংবাদিক মানিক সাহা, শামছুর রহমান, হুমায়ুন কবির বালু হত্যা, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ হত্যা, অধ্যাপক ইউনুস হত্যা, শাহ এসএমএস কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্যাহ মাষ্টার হত্যা, বাঁশখালির ১১ হত্যা, কবি শাহসুর রাহমানকে হত্যাপ্রচেষ্টার সঙ্গে কারা জড়িত? তাও দেশবাসির কাছে পরিস্কার।
সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া আদালতের রায় ‘মানি না’ বলে ধমর্ীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা ও তাদের হত্যা করতে হবে কেন? নোয়াখালি, ফেনী, পার্বত্য চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করেছে জামায়াত-শিবির। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা করাটা কিংবা অধ্যাপক আবদুল খালেকের বাসভভনে বোমা হামলা কী ইসলাম অনুমোদন করে? কেউ আস্তিক হোক আর নাস্তিক হোক সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারজন্য ব্লগার আহমেদ রাজীব শোভনকে হত্যা করে ইসলামের বারোটা বাজানো হচ্ছে না কী?
দেশে যখনই অশান্তি বাড়ে সাংবাদিক আর সংখ্যালঘুরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এবারও সেই পথেই আগাচ্ছে ওরা। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আশংকা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, গোটা দেশে চলছে চোরাগোপ্তা হামলা। দেশটাকে জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেই আগুনকে উস্কে দিলেন বাংলাদেশে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনকের পত্নী। জামায়াত-শিবির হরতাল ডেকেছে রবি আর সোমবার। আর বেগম সাহেবা আরেকদিন এগিয়ে নিলেন হরতালকে মঙ্গলবার পর্যন্ত। দেশজুড়ে তাদের তান্ডবে পাঁচ পুলিশসহ অর্ধশত মানুষ নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।
একমাত্র মহান সৃষ্টিকতর্াই জানে কী ঘটবে রবি থেকে মঙ্গল এই তিন দিনের হরতালে। আরও কতরকমের নাশকতা, অরাজকতা আর নৃশংসতা অপেক্ষা করছে আমাদের সোনার বাংলায় তা বলা মুশকিল! তবে এই অরাজকতা আর সহিসংতা প্রতিরোধে সরকার কতটুকু সজাগ বা সতকর্ তাও বোঝা কঠিন? কারণ সরকার তো এটুকু জানতো যে সাঈদীর বিরুদ্ধে আদেশ দিলে তার সমর্থক বাহিনী ও দল নিশ্চয়ই ঘরে চুরি পরে বসে থাকবে না, তারা রাস্তায় নামবে।
সরকারের এতগুলি গোয়েন্দা বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি থাকার পরও জামায়াত-শিবির জেলায় জেলায় পুলিশের ওপর আক্রমণ করলো, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা করলো, পুলিশকে হত্যা করলো, হত্যা করলো সংখ্যালঘু এবং আক্রমণ করলো সংখ্যালঘু বাড়ি-ঘরে। কিন্তু সরকার কতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে বা সহিংসতা প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিল? তা নিয়েও জনমনে আছে প্রশ্ন।
দেশে-বিদেশে জামায়াত-শিবির কোটি কোটি টাকার মিশন নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছে। নানানরকম প্রচারণা, প্রপাগান্ডা চালিয়েছে, চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয় তার জবাবে কী করেছে তারও একটা ফিরিস্তি জনগণকে জানানো হোক।
সবশেষে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতি একটা অনুরোধ করে লেখার সমাপ্তি টানবো। জেনারেল জিয়া মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপির দাবি অনুযায়ী স্বাধীতার ‘ঘোষক’ ও বটে। অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবতীর্কালে জিয়ার শাসনামলে কুখ্যাত রাজাকারদের উচ্চাসনে বসানো হয়।
সে যাই হোক বিএনপির যদি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, বীরাঙ্গনা ও সম্ভ্রমহারা মা-বোন এবং শহীদ স্বজনদের প্রতি নূ্যনতম শ্রদ্ধা থাকে তবে তারা জামায়াত-শিবিরের পক্ষ ত্যাগ করবে। এখানে একটি উদাহরণ দিতে চাই। জামায়ত-শিবির কতটা ভয়ংকর তা বোঝানোর জন্য।
আমি তখন রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়ের ছাত্র এবং দৈনিক সংবাদ এর রিপোর্টার। রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়ে ছাত্রদলই ছাত্রশিবিরকে প্রতিষ্ঠা করেছে। পরে ছাত্রদল নেতা-কর্মীরাও শিবিরের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি ও আসলাম শিবিরের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। মৃতু্যর দুয়ার থেকে ফিরে আসা এই দুই নেতার মতো শত শত ছাত্রদল নেতা আছে যারা শিবিরের সন্ত্রাসের শিকার বিভিন্ন সময়ে।
কাজেই সাপকে যতই দুধ কলা দিয়ে পোষেন না কেন সাপ ফণা তুলবেই তুলবে! বিষধর সাপ নিয়ে খেলা করা আত্মহত্যারই শামিল। আপনাদেরই স্লোগান ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়। যদি তাই হয় তবে সবার উপরে দেশ সত্য। কাজেই দেশটাই যদি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো বানানোর কাজকে আপনারা এগিয়ে নেন একাত্তরের ঘাতকদের ও তাদের দলকে সমর্থন করার মাধ্যমে তবে রাজনীতি করবেন কার জ্যন্য? বরং বিএনপি জামায়াত শিবিরের সঙ্গ ত্যাগ করলে তাদের জনসমর্থন বাড়বে বৈ কমবে না। তবে এসব বলে কোন লাভ হবে বলে বিশ্বাস করি না আমি। কারণ আমরা জানি, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী!’
শুধু দৃষ্টিভঙ্গী বদলিয়ে কোন ফায়দা হবে না। দুর্নীতি আর দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, পারিবারিকীকরণ, অমানবিবতা, রাষ্ট্রীয় হত্য্যা, এসবও বন্ধ হওয়া চাই। আরও জরুরি রাজনৈতিক দলগুলিতে (সবদল নয়, তবে অধিকাংশ) প্রকৃতার্থে গণতন্ত্র চর্চা, পরমত সহিষ্ণুতা বাড়ানো। আর যুদ্ধাপরাধী সবার বিচার, ফাঁসি কী যাবজ্জীবন সেটা মুখ্য নয়। আরও জরুরি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করা। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যেতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারি রাজনৈতিক দলটির এতো ভয় কিসের? তার মানে তারাও ভোটহারানোর ভয়ে সাম্প্রদায়িক! বিএনপি-জামাততো সবার চেনা। দেশের মানুষ ভালো করেই জানেন এরা কী চায়?
আমরা আমাদের সোনার বাংলায় সহিংসতা, তান্ডবলীলা, অরাজকতা, অবিচার চাই না। চাই শুধু শান্তি, শান্তি আর শান্তি।
ছবি-গুগল থেকে সংগৃহীত।
You must be logged in to post a comment.